১৯৭১ সালে ভারতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করায় খুশি হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। এর কারণ অনেকটা ইতিহাস বিস্তৃত নাটকের মত। সেই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজুড়ে জনমত সৃষ্টি করতেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতার পর পরবর্তী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জনগণ আপাত দৃষ্টিতে স্বাধীনতা মনে করলেও তা ছিল মূলত বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। (যা বাংলাদেশের ১৮ কোটি ছাত্র জনতা ২০২৪ সালে এসে বিষয়টি বুঝতে পেরেছে এবং তারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং তারা গ্রাফীতিতে এটা লিখেছে “পিন্ডির দাসত্ব ছেড়েছি দিল্লির গোলামী করার জন্য নয়” ) “এমনটা হবে কি জন্য”?- তা মনে হতে পারে অতীতের ইতিহাস অজানা বাংলাদেশী জনগণের একটি বিরাট অংশের কাছে। তার বিস্তারিত অতি সংক্ষেপে জানতেই আজকের এ লেখা।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান, বঙ্গভঙ্গ ও তার রদ প্রসঙ্গ
——————————————————————
অধিকতর পূর্ব ইতিহাস ঘাটতে গেলে লেখাটি অনেক লম্বা হয়ে যাবে বলে সার সংক্ষেপে তা যতটা সম্ভব ছোট করে বলার চেষ্টা করব। তৎকালীন ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত মহাদেশ শাসনকারী ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে তাঁর দ্বিতীয় কার্যকালে ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রশাসনিক বিভাগ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে রাজনৈতিক ভাবে দ্বিখণ্ডিত করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের ঐ আদেশে এই বিভাজনের ফলে গঠিত হয় মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র + ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল + পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগ) এবং হিন্দু-প্রধান বঙ্গপ্রদেশ (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি + বর্ধমান বিভাগ + বিহার + ঝাড়খণ্ড + ওড়িশা রাজ্য)।
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত ভাগের পূর্বে ভারতের হিন্দু জমিদারদের জমিদারি প্রথা মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলের জন্য যেমন নিপীড়ন মূলক হয়ে উঠেছিল (কেননা হিন্দুরা জমিদার হলেও তাদের প্রজারা অধিকাংশই ছিলেন মূলত মুসলিম কৃষক) তেমনি মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ১৯০৫ সালের ঐ বঙ্গভঙ্গ হবার ফলে মুসলিমরা খুশি হলেও হিন্দু জমিদারদের এই অঞ্চল গুলোতে তাদের জমিদারির কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে বিক্ষোভ করে ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ ইত্যাদি বিষয়গুলি টেনে আনলে লেখাটি অনেক লম্বা হবে। বরং লেখাটি ছোট করতেই পূর্বের ইতিহাস বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ১৯৪৭ সালের পরে, কেন ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্ব অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে মনোযোগ দেয় সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।
ব্রিটিশ শাসন অবসানের পূর্ববর্তী সময়ে তৎকালীন বিশ্ব শাসনকারী ব্রিটিশদের কৌশলী পদক্ষেপে তৈরি করা ম্যাপের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত উপমহাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের সাথে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের সীমানা জটিলতা থেকেই গেছে। তেমন ঘটনা থেকেই তৈরি হয় হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারত ও মুসলিম অধ্যুষিত (পশ্চিম পাকিস্তান ও মাঝখানে ভারতকে রেখে এক হাজার মাইল পূর্বে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান মিলে) পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ধর্মের ভিত্তিতে ভারত থেকে ভাগ হলেও দুটি অংশের উর্দু ও বাংলা ভাষাগত পার্থক্য আপাত জটিলতা তৈরি করে। এই দুই অংশের ভাষাগত জটিলতা থেকেই তৈরি হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
ভারত কেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান কে আলাদা করতে চেয়েছিল?
———————————————————
সাম্রাজ্যবাদীদের ধারণাই থাকে তাদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করা এবং কর্তৃত্ব বজায় রাখা, তেমনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া হিন্দু জমিদারগণের জমিদারি প্রথার মাধ্যমে দরিদ্র মুসলমান প্রজা তথা কৃষকদের উপর ছড়ি ঘোরানোটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তেমনি হিন্দু রাষ্ট্রটি বৃহৎ হওয়ায় এবং ব্রিটিশ পরবর্তী জমিদারদের জমিদারি অভ্যাস থাকায় ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরেও তারা তাদের সেই কর্তৃত্ববাদী চেহারা বজায় রাখতেই পাকিস্তানের দুই অংশের উপর পরোক্ষভাবে খবরদারি বজায় রাখতে চেয়েছিল। হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান আয়তনে ছোট হলেও তাতেও কোন সমস্যা ছিল না, যদি এই অংশ দুটি একত্রে থাকতো। কিন্তু এ দুটি অংশ মিলে একটি রাষ্ট্র হলেও তার দূরত্ব ছিল ১০০০ মাইলের। এতে করে স্বভাবতই বৃহৎ অংশে দেশটির রাজধানী হবে, রাজধানী হলে সেই অংশের মানুষের সুযোগ-সুবিধা বেশি হবে, চাকুরী, ব্যবসা সহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই- এটা যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই স্বাভাবিক ঘটনা। সেক্ষেত্রে শাসকগণ ভালো হলে হয়তো পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উভয় অংশের ১০০০ মাইলের দূরত্বও কোন সমস্যা সৃষ্টি করত না। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগণ জুলফিকার আলী ভুট্টো, টিক্কা খান কিংবা ইয়াহিয়া কিংবা আইয়ুব খান কেউই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেননি।
যেমনটা আজকের এই দিনেও দিল্লিতে বসে শাসনকারী ভারতীয় রাষ্ট্রপ্রধানেরা তাদের উত্তর-পূর্বাংশের প্রায় বিচ্ছিন্ন অংশ সেভেন সিস্টার্স (আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও অরুনাচল প্রদেশ) এর উপর একপ্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে বলে ওই অঞ্চলের বসবাসকারী জনগন দাবি করে তারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা বা স্বাধীনতা চেয়ে আসছে। আর এটিও দিবালোকের মত সত্য যে, ভারতের সংযুক্ত রাজ্যগুলোর তুলনায় প্রায় বিচ্ছিন্ন এই সেভেন সিস্টার্সে বসবাসকারী জনগণের সুযোগ-সুবিধা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জীবনমান অনেকটাই নিম্নমানের। এই অঙ্গরাজ্যগুলির মানুষদের ধর্ম, বর্ণ, কৃষ্টি, কালচার কাছাকাছি হওয়ায় তারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা বহুদিন যাবত করে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে মনিপুরে টানা সহিংসতা এবং সম্প্রতি নতুন করে তৈরি হওয়া রাজ্যটিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের পাশাপাশি ড্রোন, রকেট, স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ,মর্টারশেল দিয়ে বিভিন্ন স্থানে হামলা সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগের আশংকা তৈরি করেছে। ঠিক একই কারণে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ পূর্ব পাকিস্তানিদের মনোভাব না বোঝার কারণে তাদেরকে শুধুমাত্র উৎপাদনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু সেই বৈষম্যের ধারণা থেকেই পূর্ব পাকিস্তানিদের শাসকের আসনে বসার সুযোগ তো দূরের কথা উভয় অংশের প্রজাদের মধ্যেও একটা বৈষম্যের সৃষ্টি করে। এই বৈষম্য থেকে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের শাসকের সাথে সাথে ওই অঞ্চলের মানুষের প্রতি পূর্ব পাকিস্তান অংশের মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম হয়। আর এই বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের যে ক্ষোভ সেটিকেই সুযোগ বুঝে কাজে লাগায় ভারত। আর এটি বহুল আলোচিত যে, সেই ক্ষোভের অংশ হয়ে ভারতের সাথে আঁতাত তথা ষড়যন্ত্র করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও তিনি সত্তরের নির্বাচনের পরে অবিছিন্ন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ভারতের গোপন সম্পর্কের কারণে অস্বীকার করলে, এ সংক্রান্ত সমঝোতা মূলক আলোচনার পথ বন্ধ হলে এবং ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ভুল সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ করলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা সাহসী সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে “উই রিভল্ট” বলে যুদ্ধের ঘোষণা করেন। যা নিয়েও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ “কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন” সে বিতর্ক তৈরি করে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করবে এমন তথ্য পাবার পর ওই রাতে তাজ উদ্দিন আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়ে টেপ রেকর্ডারে তার স্বাধীনতার ঘোষণা চেয়ে তাকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু সেই সময় তিনি সেই ঘোষণা দেননি এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পট তৈরি না করে বাসায় থেকে যান, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যুদ্ধ করে মরার চেয়ে বরং গ্রেপ্তার হয়ে নিরাপদে পাকিস্তানের কারাগারে থাকতে পারেন। যেটি পরবর্তীতে তাজউদ্দীন কন্যা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তারপরেও সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ না করে আওয়ামীলীগ সেই কাল থেকে দাবি করছে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন।
এছাড়াও ভারত কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশের তথা মুসলমানদের যৌথ শক্তিকে দুর্বল করা। কেননা যখন কোন রাষ্ট্র তৈরি হয় তখন তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে তার শত্রু হবার বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। আর ভারতের দুই দিকেই একই রাষ্ট্রের দুটি অংশ থাকলে তা তাদের জন্য একপ্রকার ভীতির কারণও তৈরি করেছিল। এটা সকলেরই জানা যে, ভারত পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর থেকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের ছোটখাটো ও সাময়িক যুদ্ধের পাশাপাশি বৃহদাকারে আরো ৩ টি যুদ্ধ সংঘটিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৫, ১৯৭১ সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ। এর একটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ছাড়া বাকিগুলো মূলত ছিল কাশ্মীর সহ অন্যান্য বিষয় সংশ্লিষ্ট । তবে একমাত্র ১৯৭১ সালের পাক ভারত যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফলাফল ছাড়া অন্যান্য যুদ্ধগুলোর ফলাফল ছিল জয় পরাজয় অমীমাংসিত।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার কারণ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাস বেত্তারা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে থাকেন। আর সেটি হলো, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ। যে সময় লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়কার ইতিহাসবেত্তাদের মতে, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে চা কিংবা নাস্তা খাওয়ার কথা দম্ভ করে বলেছিলেন। এবং এও প্রচলিত যে, সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের একটি রেজিমেন্ট যেটি পরবর্তীকালে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে পরিচিত হয়েছিল তার সাহসী সৈন্যরা বুকে মাইন বেঁধে আত্মাহুতি দেয়ার সাহসিকতার পরীক্ষা একটি বহুতল ভবনে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার মাধ্যমে দিয়েছিল, যা সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরাও পারেনি। পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কথা অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যরা ট্যাংক বহর নিয়ে পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে অগ্রসর হতে চাইলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের ৩০ টির ও বেশি ট্যাংক ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখে দেয় ট্যাংকের নিচে আত্মাহুতি দেয়ার মাধ্যমে। এবং সেই সাথে ধ্বংস হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রির করাচি দখলের সেই দম্ভ। ১৯৬৫ সালের সেই যুদ্ধ অসমাপ্তই থেকে যায় যাতে কোন পক্ষই জয়লাভ করতে পারেনি, তবে উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের দ্বিগুণেরও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়। পরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মাধ্যমে সেই যুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাশখন্দে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্পাদিত হবার পরের দিন সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সে সময় মৃত্যুর কারণ হিসেবে শাস্ত্রী হৃদরোগে মারা গেছেন বলে ভারত প্রচার করলেও তাঁর পরিবার তা অস্বীকার করে তদন্তের দাবি তোলে। ভারত মনে করে শাস্ত্রীর মৃত্যু তদন্ত “যুদ্ধ বিরতি চুক্তি”তে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই হৃদরোগেই তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) অনেকগুলো ইভিডেন্স ও আলামত দেখিয়ে প্রমাণ করে যে, শাস্ত্রীকে যুদ্ধ বিরতি চুক্তির পর পাকিস্তানি গোয়েন্দারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। মূলত তারপর থেকেই ভারত সরকার পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশী) সাহসী সৈনিকদের ওই যুদ্ধে বিরোচিত সাহসিকতার ভূমিকার কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি কমাতে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২৪ সালের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিজয় ও ভারতের বর্তমান হুমকির বাস্তবতা
—————————————————————–
১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর দীর্ঘ ৫৩ বছরে বাংলাদেশে যে স্বাধীনতার গল্প শোনানো হয়েছিল তা আসলে কতটা বাস্তব সেটি ২০২৪ সালে এসে ছাত্র জনতা প্রমাণ করেছে যে, মূলত ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি বরং পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে সেবা দাস হিসেবে ভারতের হাতেই তুলে দেয়া হয়েছিল, যারা এই দীর্ঘ ৫৩ বছর বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণ করার পাশাপাশি কম-বেশি বিভিন্ন সরকারের মাধ্যমে করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল। যে দেশের মানুষ এতদিন ধরে জেনেছিল তারা স্বাধীন কিন্তু দীর্ঘ ৫৩ বছর পর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের উপর উন্মুক্তভাবে আধিপত্যবাদ ও কর্তৃত্বের কারনে এটা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ আসলে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা জন্য ছিল না বরং তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান কে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার একটি যুদ্ধ মাত্র।
ভারতের বর্তমান সময়ের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি হুমকি প্রদর্শন করে তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এর সাম্প্রতিক দেয়া বক্তব্য তথা সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার বক্তব্যের পর এ বিষয়টি জোড়ালো হয়েছে যে, ভারত কি প্রচ্ছন্নভাবে তবে বাংলাদেশকেই হুমকি দিচ্ছে? এবং সেই হুমকি আসলে কতটা বাস্তবসম্মত? এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই হুমকি প্রচ্ছন্নভাবে বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছে।
কারণ বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ভারত সীমান্তে যত বাংলাদেশী নাগরিককে ভারত নির্বিচারে হত্যা করেছে, যেভাবে একতরফা নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে খরা ও বন্যা মৌসুমে দেশকে ডুবিয়ে দিয়ে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করে নিজেদের পছন্দের সরকারকে বা বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে বারবার সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে কৌশলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে পঙ্গু বানিয়ে বাংলাদেশকে সুদান বা সোমালিয়া বা কঙ্গোর মতো বানাতে চেয়েছিল তা ২০২৪ সালে এসে একতরফাভাবে ছাত্র জনতা প্রতিহত করেছে। কিংবা এই দীর্ঘ ৫৩ বছরে ক্ষেত্র বিশেষে দুই একটি ঘটনা ছাড়া সীমান্তে প্রতিবাদ কিংবা কঠিন ভাষায় জবাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খুব কমই পেয়েছে।
এমনকি সম্প্রতি পাঁচ ভারতীয় নাগরিক আটক, দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে সীমান্তে নিয়ম ভেঙ্গে জিরো পয়েন্টের অভ্যন্তরে ভারত রাস্তা করতে গেলে বাংলাদেশের সাহসী বর্ডার গার্ড তাতে বাধা প্রদান করে (সতর্কতা না মানার পর) গুলি ছোঁড়ার মাধ্যমে। এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ডক্টর ইউনুস দেশের ক্ষমতা ভার নেয়ার পর ভারত সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড যা দীর্ঘ ৫৩ বছরেও ভারত দেখেনি (ক্ষেত্রবিশেষে দুই একটি ঘটনা ছাড়া)। পাশাপাশি তার অনুগ্রহে থাকা বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ক্ষমতার পতন যেন ভারতকে আরো কঠিনভাবে হতাশ করেছে। সেই সাথে তাকে ভারতে আশ্রিত রাখা কিংবা তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থতা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা ভারত এক প্রকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছে বলে এমন হুমকি প্রদান আত্মতৃপ্তির পাশাপাশি নিজ দেশের রাজনীতিতে বিরোধীসহ জনগণের চাপমুক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
কেননা ইতিমধ্যেই দেশটি তার কর্তৃত্ববাদী পররাষ্ট্রনীতির কারণে প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক এতটাই নাজুক করে ফেলেছে যে – শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল এমন কি পেটের অভ্যন্তরে থাকা ভুটানের মত রাষ্ট্রেরও বিরাগ ভাজন হয়েছে। অন্যদিকে মায়ানমারে চীনা সমর্থিত আরাকান আর্মি ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কে কোণঠাসা করার কারনে মিয়ানমার সীমান্ত তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই সাথে স্মরণ করা যায়, ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে হেরে যাওয়া, কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে দেশের বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া, বৃহৎ সীমান্ত দিয়ে বেষ্টিত চীন ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ শত্রু হওয়ায় তারা সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করার বাগাড়ম্বর যতই করুক না কেন তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কেন কোন দেশের বিপক্ষেই যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি আছে বলে মনে হয় না। কারণ যুদ্ধ করতে গেলে আগে তাদের কমপক্ষে চারটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হতে পারে। তার আগে মনিপুর রাজ্যে যা শুরু হয়েছে তা যদি বিস্ফোরক আকারে সেভেন সিস্টার্সের অন্য ছয়টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে তবে তারা বহিঃ শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে নাকি দেশ সামলাবে তা নিয়ে ভাবতেই তাদের গা শিউরে ওঠার কথা। কেননা ভু রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটি সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ভারত থেকে সামান্য আক্রমণের খবর পাকিস্তান কিংবা চীনের কাছে গেলেই সেটি তাদের জন্য সাপে বর হবে। ফিলিস্তিন ইসরাইল যুদ্ধ কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে রাশিয়া আমেরিকার প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে ভারত-বাংলাদেশে যুদ্ধ করার মতো স্পর্ধা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। আর সেটি করতে গেলে ভারত ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হবার পাশাপাশি নিজ দেশের সেভেন সিস্টার্স সহ অন্যান্য স্বাধীনতা কামী রাজ্যগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হতে পারে বিভিন্ন রাজ্যে। যে কারণে দুর্বল ভিত্তির উপর গঠিত সরকারও অস্থির পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো বিক্ষোভের মুখে পরে ক্ষমতার মসনদ হারালেও অবাক হবার মত কিছু থাকবে না। খন্ড বিখন্ড হয়ে যেতে পারে তাদের এই মহারাষ্ট্রটির- এমন কথা অমূলক বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট