ঈমান আকীদা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে হৃদয় উজাড় করে মহব্বত করা। নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ের ঊর্ধ্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে স্থান দেয়া এবং তাঁদেরকে সবচে বেশি মহব্বত করা। কেননা এর অন্যথা হলে কোনো মুমিন মুমিন হতে পারে না।
প্রিয় পাঠক বৃন্দকে ! আজ আমি আপনাদের সামনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তা এমন একটি বিষয়, যা আমাদের সবারই প্রয়োজন এমন একটি বিষয়, যার উপস্থিতি ঈমানের এক অপরিহার্য শর্ত। বিষয়টি হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে হৃদয় উজাড় করে মহব্বত করা। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ের ঊর্ধ্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে স্থান দেয়া এবং তাঁদেরকে সবচে বেশি মহব্বত করা। কেননা এর অন্যথা হলে কোনো মুমিন মুমিন হতে পারে না। সূরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সূরা আত-তাওবা:২৪)।
কাযী ইয়ায রহ, বলেন, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করা ফরজ সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়ে দলীল ও প্রমাণস্বরূপ এই একটিমাত্র আয়াতই যথেষ্ট। কারণ এ আয়াতে ঐসব লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়েছেন যাদের কাছে নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের চেয়ে বেশি প্রিয়। আর তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্তশীর্ষক ঘোষণার মাধ্যমে তাদেরকে সাবধান করেছেন। অতঃপর আয়াতের শেষাংশে এ জাতীয় লোকদেরকে ফাসেকদের কাতারে শামিল করেছেন। আর জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা ঐ পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করেন না। (আশ-শিফা) ।
হাদীসে এসেছে :
তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে সবচে প্রিয় হবো তার মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি এবং সকল মানুষ থেকে (বুখারী ও মুসলিম)।
উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত সকল মুহাব্বতের উর্ধ্বে রাখাও অত্যাবশ্যক। কারণ রাসূল আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, যে সবকিছু থেকে আমাকে বেশি মহব্বত না করবে সে মুমিন হতে পারবে না। এ থেকে বুঝা যায় যে, ঈমানের অস্তিত্বের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত অত্যাবশ্যক। আর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত ছাড়া ঈমানের স্বাদও অনুভব করা সম্ভব হয় না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম ইরশাদ করেছেন :
তিনটি গুণ যার মাঝে থাকবে সে ঈমানের স্বাধ উপভোগ করতে পারবে : (১) আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অন্য সবকিছু থেকে তার কাছে অধিক প্রিয় হওয়া (২) একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাউকে মহব্বত করা এবং (৩) ঈমান আনার পর কুফরে ফিরে যাওয়াটা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দের হওয়া।
আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই ! মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা এই যে, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো সম্পর্কে সে সচেতন থাকে। মহব্বত শুধু মুখে মুখে দাবি করার বিষয় নয়, বরং মুহাব্বতের পক্ষে দলীল পেশ করতে হয়। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে আমরা মহব্বত করি এটি একটি দাবি। এই দাবির পক্ষেও প্রমাণ পেশ করতে হবে। অন্যথায় এ দাবি অর্থহীন ও মিথ্যা বলে পরিগণিত হবে।
তাহলে এবার আসুন, দেখা যাক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করার আলামতগুলো কি কি? উলামায়ে কেরাম কোরআন ও হাদীস অনুসন্ধান করে মুহাব্বতের আলামতগুলো বের করেছেন। এসব আলামতের মধ্যে একটি হলো, আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ ও আনুগত্য করা, রাসূলের আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা এবং রাসূলের প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা। ইরশাদ হয়েছে :
বল, যদি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে মহব্বত করবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। আর আল্লাহ চিরক্ষমাশীল, পরমদয়ালু (আলে ইমরান : ৩১)।
কাযী ইয়ায বলেন: কোনো ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলে সে তাকে প্রাধান্য দেয় তার পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেয়। অন্যথায় মুহাব্বতের দাবিতে সে মিথ্যাবাদী বলে বিবেচিত হবে। তাই সত্যিসত্যি যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহব্বত করে, অবশ্যই তার আচার-আচরণে সে মুহাব্বতের আলামতও প্রকাশ পাবে। আর এসব আলমতের মধ্যে প্রধান হলো, রাসূলের অনুসরণ ও তাঁর সুন্নতের অনুসরণ, কথা ও কাজে তাঁর আনুগত্য করা। তাঁর নির্দেশসমূহ মেনে চলা এবং যেসব বিষয় থেকে তিনি নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে চলা। বল, যদি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর তাহলে আমার ইত্তিবা কর। আল্লাহ তোমাদেরকে মহব্বত করবেন এ আয়াতটি এরই প্রমাণ বহন করে।
রাসূলের মুহাব্বতের আলামত হলো তিনি যে বিষয়গুলো বিধিবদ্ধ করেছেন প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার উপরে সেগুলোকে প্রাধান্য দেয়া। ইরশাদ হয়েছে :
আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা মদীনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ঈমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে), আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালবাসে। আর মুহাজরিদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোন ঈর্ষা অনুভব করে না। এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম (সূরা আল হাশর:৯)।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করার আলামত হলো তার দীনকে নুসরত করা, দীনের প্রতি আঘাত এলে তা প্রতিহত করা। তাঁর সুন্নত ও আদর্শের প্রতি আঘাত এলে তা প্রতিহত করা। রাসূলকে মুহাব্বতের আলামত হলো তাঁর উপর নাযিল হওয়া কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াত মহব্বতের বিষয়ে পরিণত হওয়া। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাতের শাওক বা আগ্রহ রাখা। অর্থাৎ সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। কারণ মৃত্যুর মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করতে পারে। আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকার অর্থ হলো আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবনযাপন করা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যাদেরকে মহব্বত করেন ও ভালোবাসেন তাদেরকে মহব্বত করা এবং যাদেরকে অপছন্দ করেন তাদেরকে অপছন্দ করা।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত লাভের উপায়
আমার প্রিয় পাঠক বৃন্দকে আমি বলতে চাই! আমাদের মধ্যে আল্লাহর এমন অনেক বান্দা রয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন। প্রিয় ভাই! ইচ্ছে করলে আপনি-আমিও হতে পারি আল্লাহর সেই সৌভাগ্যবান বান্দা। শুধু সামান্য একটু চেষ্টা ও মেহনত এবং কুরবানী মুজাহাদার মাধ্যমেই আমরা হাসিল করতে পারি আল্লাহর মহব্বত। কোরআন ও হাদীসে এমন কিছু আমলের কথা উল্লেখ রয়েছে যেগুলো করলে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ভালোবাসা দান করেন, আমালগুলো হলো-
আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখা এবং নেক আমল করতে থাকা। ইরশাদ হয়েছে :
যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে অবশ্যই রহমান তাদের জন্য (বান্দাদের হৃদয়ে)ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিবেন (সূরা মারয়াম : ৯৬)।
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীস আনুযায়ী, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিব্রিল আ.-কে ডেকে বলেন, হে জিব্রিল, আমি উমুককে মহব্বত করি, অতঃপর তুমিও তাকে মহব্বত করো। জিব্রিল আ. তাকে মহব্বত করেন ও আকাশবাসীদেরকে ডাক দিয়ে বলেন, যে নিশ্চয় আল্লাহ উমুককে ভালোবাসেন, অতঃপর আকাশবাসীরা তাকে ভালোবাসে। এরপর তার জন্য পৃথিবীতে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা রাখা হয় (আহমদ)।
দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসীবতে সবর করা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। ইরশাদ হয়েছে :
নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন (সূরা বাকারা : ১৫৩)।
সব সময় সৎকর্ম করা, অন্যায়-কর্ম থেকে বিরত থাকা: ইরশাদ হয়েছে :
আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন (সূরা আলে ইমরান : ১৪৮)।
কখনো কোনো অন্যায়-অপরাধ হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে সকাতরে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং খাঁটি দিলে তাওবা করা। আর সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকা: ইরশাদ হয়েছে :
নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে মহব্বত করেন এবং মহব্বত করেন পবিত্রতা অর্জনকারীদেকে (সূরা আল- বাকারা : ২২২)।
আমার প্রিয় পাঠক বৃন্দ! আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত লাভের পথ ও পদ্ধতি যখন আমরা জানতে পারলাম তখন আমাদের অবশ্য কর্তব্য হয়ে গেল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত লাভের চেষ্টা করা। এ জন্য আমাদের করণীয় হবে উল্লিখিত আমলগুলো বেশি বেশি করা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা।
আমার প্রিয় পাঠক বৃন্দরগণ ! সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে নিজদের জানমাল ও পরিবার-পরিজন থেকে বেশি মহব্বত করতেন। আর বিভিন্ন জিহাদের ময়দানে এবং হিজরতের কঠিন মুহূর্তে সাহাবায়ে কেরাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি মহব্বতের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার কোনো নজীর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন:
আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে (সূরা আল বায়্যিনাহ : ৮)।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের মহব্বত কেমন ছিলো নিম্নের হাদীসগুলো থেকে তার যৎকিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায়।
আমর ইবনুল আস রা, থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক প্রিয় ও মর্যাদার অধিকারী আমার কাছে অন্য কেউ ছিলো না। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি সম্মান ও মর্যাদার কারণে আমি দৃষ্টি ভরে তাঁর দিকে তাকাতে পারতাম না। সুতরাং আমাকে রাসূলের অবয়ব বর্ণনা করতে বলা হলে আমি তা পারব না। কেননা দৃষ্টি ভরে রাসূলের দিকে আমি কখনো তাকাতাম না (মুসলিম)।
একদা আলী রা, কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আপনাদের মহব্বত কেমন ছিলো? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছে তিনি আমাদের ধন-সম্পত্তি, সন্তান-সন্তুতি ও বাবা-মার চেয়েও অধিক প্রিয় ছিলেন। এমনকি তীব্র পিপাসার সময় ঠাণ্ডা পানি যেমন প্রিয়, আমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল তার চেয়েও অধিক প্রিয় ছিলেন।
প্রিয় পাঠক বৃন্দকে জানাতে চাই ! উল্লিখিত আলোচনার নিরিখে আমরা প্রত্যেকে নিজের অবস্থা নিজে যাচাই করে দেখি। পরখ করে দেখি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে আমরা কতটুকু মহব্বত করি আল্লাহর রাসূলকে আমরা কতটুকু মহব্বত করি। মুহাব্বতের দাবি কতটুকু, আর বাস্তবে আছে কতটুকু এবং কতটুকু হওয়া দরকার।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বতের পরিপন্থী বিষয়সমূহ
প্রিয় পাঠকগণ ! কিছু বিষয় রয়েছে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বতের সাথে সাংঘর্ষিক। তন্মধ্যে একটি হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুমোদন নেই এমন বিষয়কে দীন হিসেবে পালন করতে শুরু করা। দীনের নামে নতুন কিছু আবিষ্কার করা যা শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলে খ্যাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
যদি কেউ এমন কোনো কাজ করে যার ব্যাপারে আমার কোন নির্দেশনা নেই তাবে তা বাতিল। তাই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :
বল, যদি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাবেন (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিচ্ছেন, যদি তোমরা রাসূলের ইত্তিবা তথা অনুসরণ কর, তাহলে তোমরা যা চাচ্ছ অর্থাৎ আল্লাহকে তোমরা ভালোবাসবে তারচে ওপরের মাকাম আল্লাহ তোমাদেরকে দান করবেন। স্বয়ং আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন। আর মর্যাদার বিষয় এটাই। কারণ আমি ভালোবাসি এতে কোন বিশেষত্ব ও মর্যাদা নেই, বিশেষত্ব ও মর্যাদার বিষয় হলো যে তিনি আমাকে ভালোবাসেন।
হাসান আল বসরী রহ. ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম বলেন, এক শ্রেণীর লোক আল্লাহকে মহব্বত করার দাবি করে বেড়ায়। নিচের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছেন-
সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ না করে আল্লাহকে মহব্বত করার দাবি করা একটি অবাস্তব ও অবান্তর দাবি। আর রাসূলকে মহব্বত করার দাবি যারা করে তাদের কর্তব্য হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর খলীফাদের সুন্নতের অনুসরণ-অনুকরণ করা।
হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
তোমাদের কর্তব্য হলো, আমার সুন্নতের অনুসরণ করা এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নত অনুসরণ করা এবং খুব মজবুতভাবে তা আঁকড়ে ধরা। আর দীনের ক্ষেত্রে নতুন সৃষ্ট তরীকা থেকে সতর্ক থাকবে, কেননা দীনের ক্ষেত্রে যে কোনো নতুন তরীকাই বিদআত, আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী (আবু দাউদ, সহীহ)।
সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো সুন্নাত আঁকড়ে ধরা এবং বিদআত থেকে বেঁচে থাকা। তাহলেই আমরা আল্লাহ ও রাসূলকে মহব্বতের দাবিতে সত্যবাদী বলে নিজদেরকে প্রমাণ করতে পারব।
আমার প্রিয় পাঠক বৃন্দর ! বান্দা হিসেবে আমাদের ওপর আমাদের খালেক ও মালেক আল্লাহর কিছু হক রয়েছে, যা পালন করা প্রত্যেক বান্দার জন্য খুবই সহজ। যদি আমরা আল্লাহর সে হকগুলো পালন করি, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দিবেন না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায রাদ্বি. কে জিজ্ঞাসা করে বলেন, তুমি কি জান বান্দার উপর আল্লাহর হক কি? তিনি বললেন,আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক না করা। (কিছু সময় পর তিনি আবর জিজ্ঞাসা করে বললেন, তুমি কি জান আল্লাহর উপর বান্দার হক কি? তিনি বললেন,আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো, যে তার সাথে কোন কিছু শরীক করেনি তাকে আযাব না দেওয়া (বুখারী)।
প্রিয় পাঠক ! একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারব, সামান্য আমলের বিনিময়ে আল্লাহ আমাদের জন্য কত বিরাট পুরস্কার রেখেছেন। শিরক না করার বিনিময় হিসাবে আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরচে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে? তারপরও যদি আমরা আল্লাহর হক আদায় না করি তাহলে তো মহব্বতের ন্যূনতম দাবিও আমরা রক্ষা করলাম না।
প্রিয় পাঠকগণ! উম্মতের উপর রাসূলের অসংখ্য-অগণিত হক রয়েছে। সে সব হক আদায় না করে রাসূলের ভালোবাসার দাবি করা ফাঁকা বুলি মাত্র, যা বাস্তাবে কোন কাজে আসবে না। তাই আমাদের উচিত, রাসূলের হকগুলো আদায় করা যেন কাল কিয়ামতের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম আমাদের জন্য সুপারিশ করতে পারেন। উম্মতের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম এর অন্যতম হক হলো, তাঁর প্রতি বেশি বেশি দরূদ পড়া। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা উম্মতকে এর নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে :
আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং ফিরিশতারাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর (অর্থাৎ দরূদ পড়) এবং নবীকে যথাযথভাবে সালাম জানাও (সূরা আহযাব : ৫৬)।
উম্মতের ওপর রাসূলুল্লাহ সা. এর আরেকটি হক হলো, তাঁর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও তাজীম প্রদর্শন করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
তোমরা পরস্পরকে যেভাবে ডাকো রাসূলকে সেভাবে ডেকো না (সূরা নূর : ৬৩)।
আর দুষ্ট ও মন্দ লোকের থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম ও সাহাবীগণকে রক্ষা করাও উম্মতের উপর রাসূলের বড় একটি হক। অর্থাৎ অনেক মন্দ ও দুষ্ট লোক আছে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম ও সাহাবীদের শানে কটুবাক্য উচ্চারণ করে এবং তাঁদের ব্যাপারে অশালীন ও অশোভন মন্তব্য করে। উম্মতের দায়িত্ব হলো তাদেরকে যুক্তির আলোকে বুঝানো। তাতে কাজ না হলে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া, যাতে পরবর্তীকালে অন্য কেউ এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হবার স্পর্ধা দেখাতে না পারে।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হৃদয়-অন্তর আপনার মহব্বত ও আপনার রাসূলের মহব্বতে ভরে দিন। সর্বোচ্চভাবে আপনাকে ও আপনার রাসূলকে মহব্বত করার তাওফীক দিন। স্ত্রী-সন্তান, ধন-দৌলত, এমনকি পৃথিবীর সকল কিছুর ঊর্ধ্বে আপনাকে ও আপনার রাসূলকে মহব্বত করার তাওফীক দিন।
হে আল্লাহ! আপনার ইবাদত ও আপনার রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে যেন আপরা আমাদের মহব্বতের প্রকাশ ঘটাতে পারি সেই তাওফীক আমাদেরকে দান করুন।
হে আল্লাহ! আপনার রাসূলের ইজ্জত-এর প্রতি যদি কেউ আঘাত করে তাহলে তা প্রতিহত করার তাওফীক আমাদেরকে দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে প্রকৃত অর্থে দীনের মুত্তাবে বানান। আপনার রাসূল যেভাবে দীন চর্চা করতে বলেছেন ঠিক সেভাবে আমাদেরকে দীন চর্চার তাওফীক দান করুন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকল বিষয়-আশয় দুরস্ত করে দিন। আপনার রহমত ও করুণায় আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন আল্লাহুম্মা আমিন।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আল্লাহ পাক যেন আমাদের হৃদয়-অন্তর আপনার মহব্বত ও আপনার রাসূলের মহব্বতে ভরে দিন। সর্বোচ্চভাবে আপনাকে ও আপনার রাসূলকে মহব্বত করার তাওফীক দিন। স্ত্রী-সন্তান, ধন-দৌলত, এমনকি পৃথিবীর সকল কিছুর ঊর্ধ্বে আপনাকে ও আপনার রাসূলকে মহব্বত করার তাওফিক দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন। লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী। সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী হযরত দরিয়া শাহ্ (রহ.) মাজার জামে মসজিদ সিলেট। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জকিগঞ্জ উপজেলা সচেতন নাগরিক ফোরাম সিলেট।