কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ‘জশনে জুলুস’ মিছিলকে কেন্দ্র করে হত্যা, মসজিদ, মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৮ শতাধিক লোককে আসামি করে কুলিয়ারচর থানায় পৃথক দুটি মামলা রুজু হয়েছে।
মসজিদে হামলা, ভাংচুর, মারধোর ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাত ০০:৪৫ ঘটিকার সময় উপজেলার বড় ছয়সূতী গ্রামের মৃত তাহের উদ্দিনের ছেলে মো. হানিফ মিয়া (৬৭) বাদী হয়ে সৈয়দ ফয়জুল আল আমিন (৪৮) কে প্রধান আসামি করে ৬৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২৫০ জনের নামে কুলিয়ারচর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-০৩। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সোমবার দিবাগত রাতে মামলায় এজাহারভূক্ত আসামী ছয়সূতী গ্রামের মৃত সৈয়দ মঞ্জুরুল হামিদ এঁর ছেলে সৈয়দ ফয়জুল আল আমিন (৪৮), সৈয়দ ফয়জুল মুরসালিন (৪৪), মো. ছেনু মিয়ার ছেলে মো. রাজু মিয়া (২৪), মো. হানিফ মিয়ার ছেলে মো. শাহিদ মিয়া ওরুফে শহিদ (২৩), রঙ্গু ভূইয়ার ছেলে আমির মিয়া (৪০), খুর্শিদ খানের ছেলে চাঁন মিয়া (৪০), ছোট ছয়সূতী গ্রামের শুক্কর আলীর ছেলে শফিকুল মিয়া (৪০), তদন্তেপ্রাপ্ত সন্দিগ্ধ ছয়সূতী প্রতাপনাথ বাজারের মো. সিদ্দিক মিয়ার ছেলে মো. তুষার মিয়া (১৮) ও ছোট ছয়সূতী পূর্বপাড়া গ্রামের মো. রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে মো. রকি মিয়া (২০) কে গ্রেফতার করে পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল অনুমান ১১.৪৫ ঘটিকার সময় আসামীগন পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে বেআইনি জনতা বদ্ধে দাঙ্গার উদ্দেশ্যে দেশীয় মারাত্মক অস্ত্রাদি নিয়া ছয়সূতী বাসস্ট্যাড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসিয়া মসজিদের দরজা জানালা কোপাইয়া ও বাইডাইয়া ভাংচুর করে এ সময় মীর মো. আরিফ মিলন, মুফতি আবু লায়েছ, মো. রেদোয়ান ও শাহীন মিয়া মসজিদ ভাংচুর করিতে বাধা নিষেধ দিলে তারা মীর মো. আরিফ মিলন, মো. রেদোয়ান, মুফতি আবু লায়েছ ও শাহীন মিয়াকে মারধোর করে। পরে স্থানীয়রা আহত মীর মো. আরিফ মিলনকে উদ্ধার করে ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফ মিলনকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাংচুরের ঘটনায় জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম কুলিয়ারচর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আব্দুল কাইয়ুম খাঁন (৬০) কে
প্রধান আসামি করে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত নামা ৫০০ জনের নামে কুলিয়ারচর থানায় একটি মামলা রুজু হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার ছয়সূতী গ্রামের সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদ (রহ.) এঁর ছেলে সৈয়দ ফয়জুল আল আমিন (৪৮) এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং- ০৪।
মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন, মাওলানা মো. হানিফ (৬৫), মাওলানা ইব্রাহিম (৫৫), মাওলানা আহাম্মদ আলী (৪৫), মাওলানা লায়েছ (৬৫), মাওলানা আসাদুল্লাহ (৫৬), মো. ফরিদ মিয়া (৩০), আতাউর রহমান (৪০), মনজিল মিয়া (৩৭) ও আঙ্গুর মিয়া (৪৫)।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ছয়সূতী গাউছিয়া দরবার শরিফ এর ভক্তবৃন্দগন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর জশনে জুলুসের মিছিলে অংশগ্রহণ করায় আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়। এই আক্রোশে আসামিগন পরিকল্পিতভাবে বেআইনী জনতা বন্ধে দাঙ্গার উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্রাদি নিয়ে ছয়সূতী দরবার শরিফে প্রবেশ করিয়া মুফতি আবদুল কাইয়ু খাঁনের নির্দেশে দরবার শরিফে হামলা ও ভাংচুর করে এবং দরবার শরিফে থাকা অন্যান্য কয়েটি খানকা ঘর ভাংচুর করে। এছাড়া ঘরে থাকা অন্যান্য জিনিসপত্র লুটপাট করিয়া নিয়া যায়। পরে তারা দরবার শরীফ সংলগ্ন ছয়সূতী প্রতাব নাথ বাজারে প্রবেশ করিয়া রূপ বানু ও রিয়াজ উদ্দিনের দোকানপাট ভাংচুর ও লুটপাট করে তাদের মারধর করে। এসময় মনির ভূইয়াকেও মারধোর করে তারা। পরে আসামিরা ছিদ্দিক মিয়ার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া হামলা ও ভাংচুর করে মারধোর ও লুটপাট করে এবং হুমকি ধামকি দেয়। গাউছিয়া দরবার শরিফে আঘাত করিয়া ধর্মীয় অনুভুতিতে আগাত করে। পরে স্থানীয়রা আহত রুপবানু ও মনির ভূইয়াকে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে চিকিৎসা করান। বাদী চিকিৎসাধীন থাকায় মো. মহসিন (৫০) এর মাধ্যমে থানায় অভিযোগ পাঠান তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর যাবৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ইমাম উলামা পরিষদ পৃথক পৃথক ভাবে ছয়সূতী ইউনিয়নে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করে আসছে। মাজারপন্থী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সংগঠনের সদস্যরা জশনে জুলুস কর্মসূচি পালন করে। মাজার বিরোধী অপর পক্ষ সিরাদুন্নবী (সা.) নামে পৃথক কর্মসূচি পালন করে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে বুধবার ছয়সূতি গাউছিয়া দরবার শরিফে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীর। তাঁর আগমনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ উপজেলা ইমাম ওলামা পরিষদের নেতারা। তাহেরীর আগমন ঠেকাতে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরার কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। বিষয়টি সুরাহার জন্য কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সারোয়ার জাহান’কে দায়িত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ওসি গত রোববার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতাদের সঙ্গে সভা করে ওয়াজ মাহফিল স্থগিত করান।
এ অবস্থায় ইমাম ওলামা পরিষদ সোমবার সকাল ১০টায় ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিরাদুন্নবী (সা.) কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একই সময় জশনে জুলুশের মিছিল বের করার ঘোষণা দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। ওসির মধ্যস্থতায় ইমাম ওলামা পরিষদের সকাল ১০টার কর্মসূচি স্থগিত করে কর্মসূচির পরবর্তী সময় নির্ধারণ করে দেন ওইদিন বিকেলে।
পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ১০ টার দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদ (রহ.) এঁর ছয়সূতী গাউছিয়া দরবার শরীফ থেকে ঈদে মিল্লাদুন্নবীর জশনে জুলুসের মিছিল বের করে মাধবদী হয়ে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসার পথে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এসময় জশনে জুলুস মিছিল থেকে কিছু লোক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধা অতিক্রম করে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে এসে মসজিদে অবস্থানরত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও মসজিদ ভাংচুর করে । এসময় বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ীরাসহ স্থানীয় মুসল্লি, মসজিদ মাদ্রাসার আলেম-ওলামা ও ছয়সূতী ইউনিয়ন বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়ার সহ-সভাপতি মো. মীর আরিফ মিলন হামলাকারীদের বাধা নিষেধ দেয়। বাধা দিতে গেলে হামলাকারীরা মো. মীর আরিফ মিলনের উপর হামলা করে তাকে মারধোর করে। এসময় ইটপাটকেলের আঘাতে ছয়সূতী খাদেমুল ইসলাম হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. হানিফ মিয়ার ছেলে রেদোয়ান ও নিজগাঁও মসজিদের মুয়াজ্জিন চক্ষু প্রতিবন্ধী (অন্ধ) মো. শাহিন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মো. মীর আরিফ মিলনকে উদ্ধার করে ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তবর্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত দুই ছাত্রকে উদ্ধার করে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
পরে উত্তেজিত জনতা ও মাদ্রাসার শিক্ষক শিক্ষার্থীরা
গাউছিয়া দরবার শরিফে হামলা ও ভাংচুর করে। এছাড়া তারা প্রতাপনাথ বাজারে বেশ কয়েটি দোকানপাট ও বাড়ি ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে কয়েকজনকে মেরে আহত করে।
ঘটনারপর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত এলাকায় অসংখ্য সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।।
এব্যাপারে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সারোয়ার জাহান বলেন, মসজিদে হামলা, মারধোর ও হত্যার অভিযোগে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ৭ জন ও ঘটনার সাথে সন্দিগ্ধ ২ জনকে গ্রেফতার করে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। অপর দিকে মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাংচুর ও মারধোরের ঘটনায় আরো একটি মামলা রুজু হয়েছে। দুটি মামলার আসামিদের সনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।